আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫ ● ৪ ভাদ্র ১৪৩২
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫

বৈষম্য দূর করতে অঞ্চলভিত্তিক বাজেট  প্রণয়নের বিকল্প নেই

রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, বিকাল ০৫:৩৬

Advertisement Advertisement

- নজরুল মৃধা

বর্তমানে দেশ চালাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতত্বে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পরে এই সরকারকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় সামনে জাতীয় বাজেট। বাজেট ঘোষণা এবং তা বাস্তবায়ন এই সরকারেরর চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ। এই সরকার অঞ্চলভিত্তিক  বাজেট প্রণয়ন করলে দেশের বিভিন্নস্থানের অঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে সক্ষম হবে। অঞ্চল ভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করতে পারলে এ সরকারের যুগান্তকারি একটি সাফল্য লাভ করবে বলে সুধিজনরা মনে করছেন। কারণ আমাদের দেশের জনগণের আশা আকাঙ্খা প্রত্যাশা ও সময়ের বাস্তব চাহিদা মোকাবেলায় প্রতিবছর বাজেট প্রনীত হলেও বাজেটের সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন  কখনোই দেখা যায়না। ঘোষিত বাজেটে লক্ষ্য করা যায় আমলাতান্ত্রিক, সচিবালয় ভিত্তিক ও রাজধানী কেন্দ্রীক। বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বরাবরই আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে দেশের অনুন্নত এলাকাগুলো। বাজেটে কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ থাকলেও তা থেকে বরাবরই উত্তরাঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বাজেট প্রণোনয়ন প্রক্রিয়ায় উত্তরাঞ্চলের তৃণমূল জনগণের অংশগ্রহণ এবং তাদের অধিকারের কথা কখনোই প্রতিফলিত হয়নি। অঞ্চলভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন না করার ফলে বাজেট ঘোষণা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে এমন মন্তব্য অনেকের কাছেই শোনা যাচ্ছে। 

বাজেট বলতে এদেশের মানুষের ধারণা নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম কমলো আবার কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়লো। কিছু দ্রব্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি আবার কিছু দ্রব্যের উপর শুল্ক কম এর বাইরে কিছু ভাবা যায় না। আসলেই কি বাজেট কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি অথব কমা তা কখনোই না। অঞ্চলভিত্তিক তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের চাহিদা ও পরামর্শের আলোকে বাজেট প্রণিত হলেই এদেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব। মাঠ পর্যায়ে মতামত গ্রহণ না করে চেয়ার টেবিলে বসে বাজেট প্রণয়ন করলে তার ফলাফল লাভ ও মূল্যায়ন থেকে তৃণমুল পর্যায়ে জনগণ বঞ্চিত এবং আঞ্চলিক বৈষ্যমের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর। এ অঞ্চলে কৃষিতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্বেও সুষ্ঠু বাজেট প্রণয়ন না হওয়ার কারণে রংপুর অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবন যাত্রার মান পিছিয়ে পড়ছে দেশের অন্যান্য স্থানগুলোর চেয়ে। রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও বঞ্চিত হয় কাঙ্খিত আকাঙ্খা থেকে।  জিনিসপত্রের দাম বেশি এবং আয় উপার্জনের কোন পথ না থাকায় এসময়টি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর জীবনে অনিশ্চয়তা এখনো প্রকট।  উত্তরাঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের মাঝে প্রায় ২ কোটি মানুষই দারিদ্র্যতার মাঝে বাস করে। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী উত্তরঞ্চলের রংপুর বিভাগের ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ নদী ভাঙ্গন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অভাবের কারণে ভূমিহীন। এ অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ ক্ষেত মজুর, ২৭ শতাংশ শ্রমিক, ১০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক, ৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ২ শতাংশ অন্যান্য পেশার সাথে যুক্ত।

অঞ্চল ভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাজেট প্রণয়ন না করায় এই জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে কোন সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারছে না জাতীয় বাজেট। দীর্ঘদিন থেকে অবহেলিত এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু নীতিমালা ও আঞ্চলিক বাজেট প্রণয়ন না হওয়ায় স্বাধীনতার  এত বছরেও এ অঞ্চলের তেমন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে কয়েকটি চিনিকল চাল থাকলে বিগত সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছে। ,নীলফামরীতে উত্তরা ইপিজেড ছাড়া এ অঞ্চলে শিল্প বলতে তেমন কিছু নেই বলেই চলে। ফলে কৃষির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এখানকার অর্থনীতি। নদী ভাঙ্গন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষিতে লোকসান ইত্যাদি কারণে অনেক কৃষক তাদের জমিজমা হারিয়ে দিন মজুরে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ দেখা যায় না জাতীয় বাজেটে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন আমাদের দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দেয় যমুনা সেতু । এ সেতুটি উদ্বোধনের পর উৎপাদিত কৃষিপণ্য ঢাকায় এনে বিক্রি করা এবং মানুষের যাতায়াত সুবিধার বাইরে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় কোন অবদান রাখতে পারছে না যমুনা সেতু। যোগাযোগের অগ্রগতি হলেও রংপুর অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়েনি উদ্যোক্তাদের। বাইরে থেকে কোন শিল্প উদ্যোক্তাই এইঅঞ্চলে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছে না। অপর দিকে আশানুরূপ বাড়ছে না কর্মসংস্থান। প্রতি বছরই বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে।  সারা দেশে ৫ হাজারের ওপরে গার্মেন্টস শিল্প রয়েছে কিন্তু এ শিল্পে রংপুরের কোন ভূমিকা নেই। দেশের প্রায় ১২শ টেক্সটাইল মিলের মধ্যে দুটির অবস্থান এ অঞ্চলে। একটি দিনাজপুরে অন্যটি কুড়িগ্রামে । এগুলো এখন বন্ধ। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও গ্যাস না থাকার কারণে এই অঞ্চলে বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছে না উদ্যোক্তারা। বিনিয়োগকারীদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হলে অঞ্চলভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক বাজেট প্রণয়ন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার বিকল্প নেই। 

কৃষি সেক্টর রংপুর বিভাগের উন্নয়ন বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে জাতীয় বাজেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেহেতু এটা কৃষি নির্ভর এলাকা। কৃষি সেক্টরকেই প্রাধান্য দিতে হলে কৃষি নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। গত কয়েক বছর থেকে এ অঞ্চলের কৃষকরা আলু উৎপাদন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সুষ্ঠু নীতিমালা ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময ধান,আলুসহ অন্যান্য ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় চাষিদের। আলুর বহুবিধ ব্যবহারে এ অঞ্চলে আলুভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। শিল্পপতিরা আলুর চিপস্ সহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে এ অঞ্চলে স্থায়ী কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে জাতীয় বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে শিল্প উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসার উদ্যোক্তটি নিতে হবে বাজেট প্রণেতাদের। এছাড়াও এ অঞ্চলের উৎপাদিত শাক সবজি, তরিতরকারি স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। দেখা গেছে শাক সবজির ভরা মৌসুমে একটি সিন্ডিকেট স্বল্পমূল্যে এসব শাকসবজি ক্রয় করে অন্যস্থানে নিয়ে গিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। অথচ যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এসব উৎপাদন করছেন সেই কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এ অঞ্চলে শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের জন্য কোন সংরক্ষণাগার নেই। এই দাবিটি এ অঞ্চলের মানুষের দাবী দীর্ঘদিনের। অথচ এ দাবীর প্রতি কোন সরকারই গুরুত্ব দিচ্ছে না। এসব পণ্যের সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষনাগার স্থাপন করতে পারলে কৃষকরা যেমন তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পেত তেমনি আঞ্চলিক অর্থনীতির চাকাও সচল থাকতো। তবে এ অঞ্চলে শিল্পায়নের প্রধান অন্তরায় গ্যাস সরবরাহ। আঞ্চলিক বৈষম্যের কারণে বগুড়া পর্যন্ত গ্যাস এসে থেমে গেছে। রংপুর পর্যন্ত দ্রুত গ্যাসের সরবরাহ দেয়া হলে শিল্পপতিরা এ অঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

দেখা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) জাতীয় বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এডিপির বন্টনের ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই অঞ্চলকে বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, স্থানীয় সরকারের অন্তর্ভূক্ত না করা। সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা ইত্যাদি না থাকার কারণে এসব প্রকল্প গুলো সঠিক ও সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এসব প্রকল্প মাঠ পর্যায়ে আঞ্চলিক ভিত্তিতে প্রণয়ন হলে যেমন এলাকার উন্নয়ন হতো তেমনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বদলে সহায়ত হতো।

দেখা গেছে এই অঞ্চলে  উল্লেখযোগ্য অংশ মা চরম পুষ্টিহীনতার মাঝেই তাদের সন্তান জন্ম দেয়। রংপুর বিভাগের মানুষকে দেশের উন্নয়নের মূল্যধারায় সংযুক্ত করতে হলে চলতি বাজেটে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে হবে এবং অঞ্চল ভিক্তিক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে রংপুরে কৃষি ভিত্তিক ইন্ড্রাস্টি, আলু সংরক্ষণের সরকারী হিমাগার স্থাপন, দ্রুত পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ, নীলফামারীর সৈয়দপুরে উত্তরা ইপিজেডসহ অন্যান্য শিল্প নগরীকে আধুনিকায়ন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।  এঅঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দুর করতে  হলে আঞ্চলিক বাজেট প্রণয়নের বিকল্প নেই।।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন


Link copied